বিদ্যুতবিহীন গ্রাম্য এলাকায় চলচ্চিত্র বিনোদন
গত শতাব্দীর শেষ দশকেরও শেষের দিকের কথা। তখন ক্লাস ত্রি-ফোরে পড়ি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে থাকি। আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলনা। সে সময়ে রঙিন টেলিভিশন দেখার কোন উপায় ছিল তো না ই, সাদা-কালো টেলিভিশন দেখতেও ভরসা ছিল বার ভোল্টের ডিসি ব্যাটারি। সে ব্যাটারি চার্জ দিতে নিয়ে যেতে হত আট-নয় কিলোমিটার দূরের এক গঞ্জে। টেনেটুনে ছয়সাত দিন চলত। সিনেমা বিনোদন বলতে শুক্রবার বিকেল তিনটার সংবাদের পরে বিটিভিতে প্রচারিত একখানা যেমন খুশি তেমন চালাও ছায়াছবি।
সালমান শাহ্-শাবনুর, মান্না- মৌসুমি, শাকিল খান-পপি, রিয়াজের সময়ে দিনের পর দিন কার শুধু রাজ্জাক-ববিতা, মিঠুন-চম্পা, আলমগীর-শাবানা, জসীম-কবরীর ছবি দেখতে ভাল লাগে!! ‘ঢুস, ঢুস’ শব্দ ছেড়ে ‘ঢিসুম-ঢিসুম’ শব্দের মারামারি দেখতে ইচ্ছা কার না ইচ্ছে হয়!! সমস্ত শরীর ঢেকে রাখা শাবানাকে ছেড়ে কার না দেখতে ইচ্ছে করে পপি-শাবনুরের কোমর ঢুলানি নাচ!!
পাড়ার বড় ভাই-বোনেরা মিলে একেক সময় পরিকল্পনা করত ভিসিআর (আসলে সেটা ভিসিপি) ভাড়ায় আনার। যারা যারা এই যজ্ঞে সংযুক্ত থাকত তাদের প্রত্যেককে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে হত কারণ ভিসিআর, ব্যাটারি আর টিভি ভাড়া মিলে একটা বড় অঙ্কের টাকা খরচ হত।
কী কী মুভি দেখা হবে সেটা বড়রাই লিস্ট করত। বেশিরিভাগই থাকত বাংলা সিনেমা। এক-দুইটা হিন্দি মুভি। একদিন দুপুর বারটা থেকে পরদিন দুপুর বারটা পর্যন্ত হচ্ছে ভাড়ার সময়। বড় ভাইরা তিন-চারজন মিলে অগ্রিম কিছু টাকা দিয়ে ভিসিআর আনতে যেত। নৌকাই তখন একমাত্র বাহন হিসেবে প্রচলিত ছিল, পিচঢালা কালো রাস্তা তো ভাল, ইট বিছানো রাস্তাও ছিলনা। বৃষ্টির দিনের কর্দমাক্ত রাস্তা এবরো-থেবড়ো থাকত শুকনা মৌসুম পর্যন্ত।
বিকেল তিনটা থেকে চারটার মধ্যেই বড়মিয়া বাড়ীর কাছারি ঘরে ভিসিআর চালু হত। শুরুটা হত হিন্দি গীতমালা দিয়ে। গীতমালা কী জানেন! বর্তমানে আমরা যেটাকে মিউজিক ভিডিও নামে জানি সেটা। মুরুব্বিরা এসব দেখত না,’কী সব দেখায়, ছোড ছোড কাফুর পড়া মাইয়ারা নাচে!!’ আমরা ছোটরা আবার সেসব কোমর দোলানো নাচ হা করে দেখতাম, মাঝে মাঝে লজ্জাও পেতে চেষ্টা করতাম।
মূল অধিবেশন শুরু হত সন্ধ্যার পরে। মুরুব্বিরা পর্যন্ত মাগরিবের নামাজ পড়ে অধিবেশনে যোগ দিত। চিরাচরিত বাংলা সিনেমা শুরু হয়ে যেত। পারিবারিক পরিবেশে দেখা যায় এমন সিনেমাই আগে চালানো হত। একজন অপারেটর সার্বক্ষণিক ভিসিআর সেটের সামনে অবস্থান নিয়ে থাকত পারিবারিক পরিবেশবিরোধী যেকোন দৃশ্য কেটে দেবার জন্য। কিছুটা রোমান্টিক দৃশ্যগুলো টেনে এগিয়ে দেয়া হত আর ধর্ষণ দৃশ্য হলে তো কোন কথাই নেই, নাবালক বাচ্চারা ব্যতিত বাকী সবাই যে যার মত মুখ লুকাতে চেষ্টা করত।
ছোটদের অনেকে সারারাত বড়মিয়া বাড়ীর কাছারিঘরে আবাস গারলেও আমি এবং আমার ভাইয়ের বড়জোর রাত দশটা পর্যন্ত সিনেমা দেখার অনুমতি মিলত। এর আগে পরে কিছু কিছু মুরুব্বিরাও ঘুমাতে চলে যেতেন। শুরু হত আরেক পর্ব। এতক্ষণ ঠাসাঠাসি করে বসে থাকা লোকজন অনেকটা রিল্যাক্স হয়ে বসতে পারত। ঢালা বিছানায় মানে মেঝেতে হোগলার (মাদুর) ওপরে অনেকে কাঁথা-বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ত।
সিনেমা চলছে, একে একে ছেলে-মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ছে কেউবা ঘুমে ঢুলুঢুলু। বারটা একটার দিকে উঠতি বয়সের মেয়েদের একরকম ধমক দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হত। এরপরেও কতক থেকে যেত। রাত দুইটা তিনটার দিকে দুই-চারজন ছাড়া বাকীরা ঘুমে অচেতন। দুয়েকজন না ঘুমালেও টিভি কিছুক্ষণ বন্ধ করে রাখা হত যাতে জেগে থাকা নির্দিষ্ট কয়েকজন ছেলে ব্যতিত বাকীরা চলে যায় বা ঘুমিয়ে যায়। এসব করার উদ্দেশ্য তো একটা আছেই, তাইনা! উদ্দেশ্যটা হচ্ছে ব্লু-ফিল্ম দেখা যেটাকে আমরা এখন পর্ন মুভি হিসেবে জানি। আয়োজকদের কয়েকজন দুরুদুরু বুকে কেউ জেগে যায় কিনা, এসে পড়ে কিনা বহু চিন্তা নিয়ে উপভোগ করত কিংবা করতে চেষ্টা করত।
ভোরের দিকে মানে ফজরের নামাজের পরে আবার সামাজিক মুভি চলতে শুরু করত। আবার ছেলে-বুড়োদের সমাগম হত, এদিকে বার ভোল্টের ডিসি ব্যাটারির চার্জ কমতে থাকত। সকাল দশটা এগারটার দিকে অবশিষ্ট মুভির সংখ্যা ফুরোনোর সাথে সাথে আয়োজক এবং দর্শকদের মন খারাপ হতে শুরু হত। ভিসিআর অপারেটর সমেত যখন ভিসিআর, টিভি আর ব্যাটারি নিয়ে যেতে থাকত অনেকেরই মনে মনে বাজত বিষাদের সুর। আনন্দঘন প্রায় চব্বিশঘণ্টার পরিসমাপ্তি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন