বাংলা গানের ধারা
কেউ গান শোনে তার কথা বা লিরিকের জন্য, আবার কেউ গান শোনে সুরের কারণে। এরা এক রকমের শ্রোতা। কিন্তু গানের প্রকৃত শ্রোতা তারাই, যারা একটা গানের লিরিক এবং সুর দুটোই মনযোগ দিয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করে। বাংলা গানের ধারা যদি বলি, শুরুটা ছিল টপ্পা, পালা, এবং পুথি নির্ভর। বাউল গান ছিল মুসলিম সুফিবাদের এক ধরনের প্রকাশক। এরপরের পুরনো ধাঁচের গান ছিল গানের কথা নির্ভর এবং বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে জারী, সারী, ভাটিয়ালী গানগুলো হয়ে উঠল মূলধারার বিনোদন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিজের লেখা এবং সুর করা ২,২৩০ টি গান দিয়ে বাংলা গানের নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। নজরুল কিন্তু চার হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন যা গোটা পৃথিবীর ইতিহাসেই এক অবাক করা বিষয়। নজরুল তার নিজস্বতা বজায় রেখে বাংলা গানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও তার ওপর পারসিক(ফার্সি) সাহিত্যের বেশ প্রভাব ছিল বলে গানগুলোর সুরারোপের ওপরেও এর বলয়ের ছাপ পরে যায়। তাই নজরুলগীতি শুনলে অনেক বলে বসে, ‘এ গানের কথা ভাল হলেও সুরটা কেমন যেন।’ সেদিক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত কিন্তু অনেকের কাছেই নিজের অন্তরের সুর বলে মনে হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে দেশাত্মবোধক বাংলা গানের ধারা শুরু হয়।
বাংলা আধুনিক গানের ধারা শুরু হয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শচীন দেব বর্মনদের হাত ধরে। নতুন নতুন কথা, সুর এবং সঙ্গীতে আসলেই আধুনিক হয়ে উঠল বাংলা গানের ধারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে আধুনিক গান আরো আধুনিক হল, আজম খানের হাত ধরে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের আগমনে।
হাল জমানার বাংলা গানের সাথে তুলনা করলে আমাকে কিছুটা সেকেলে বলা চলে। আমার কাছে গানের কথার সাথে সুরের একটা সম্মিলনের ব্যাপার কাজ করে। একেক ধাঁচ বা প্যাটার্নের গানের সুর একেক ধরণের হওয়া দরকার। আপনি যদি রোমান্টিক কোন গানে হাই স্কেলের রক মিউজিক ব্যবহার করেন, আর যাই হোক আমার কাছে সেটা ছাইপাশ ছাড়া কিচ্ছু নয়।
এখন ইউটিউবের কল্যাণে আবার অত্যাধুনিক গানের ধারা শুরু হয়েছে, মিউজিক ভিডিও। এরা কি গান শোনায় নাকি ভিডিও দেখায় মাঝে মাঝে বোঝা কঠিন হয়ে পরে। যেমন-তেমন লিরিকের ওপর কোন রকম সুর বসিয়ে তাতে ভিডিওর মডেলদের ছোট কাপড় এবং আবেদনময়ী এক্সপ্রেশনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে গান বানানো হয়। বোঝার ব্যাপারটা হচ্ছে, গান বানানো, গান গাওয়া বা পরিবেশন নয় কিন্তু। অনেক কন্ঠশিল্পী আছেন, যারা গানের কথা বা লিরিক না বুঝেই গান গেয়ে ফেলেন। অথচ, গানের ক্ষেত্রে দরদ বা ফিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এত নেতিবাচক কথা বলতে ভাল লাগেনা। ইতিবাচক দিক যে একেবারেই নেই তা না। তবে, ওই যে কথায় আছে না, “একজনে জাত মারে হাজার জনের”। খারাপ বিষয়গুলো ক্যান্সারের মত খুব দ্রুত ছড়ায়। তাই আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাড়াতাড়ি। ভাল বাংলা গান আছে, অনেক আছে। যারা আসলেই ভাল গায়, তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রচার বিমুখ।
নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যেও আশা করছি, ভাল, শুদ্ধ, শালীন বাংলা গানের বিকাশ হবে যাতে আমরা বাংলা গানকে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হিসেবে গর্ব করতে পারব।
Nazmul Hasan Mehdi
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন