বাইনারি চিন্তাধারা
বাইনারি চিন্তাধারা
যুগটা ডিজিটাল। ইলেকট্রনিক সবকিছু বাইনারি হিসেবে চলে। বাইনারি হিসেব হচ্ছে, ‘০’ (শুণ্য) এবং ‘১’ (এক) নির্ভর। শূণ্য হচ্ছে নেগেটিভ অথবা অফ এর প্রতীক আর এক হচ্ছে পজিটিভ অথবা অন এর প্রতীক। যারা কম্পিউটারে দক্ষ তারা ব্যাপারটা ভাল করে বলতে পারবেন। সামাজিক বিজ্ঞানের ছাত্র হবার কারণে আমার বোঝার যায়গাটা একটু ভিন্ন।
বর্তমান সময়ে যে কোন ইস্যুতে জনমতও যেন বাইনারি হিসেবে চলছে। আপনি নীতি, আদর্শ, ঘটনার বিশ্লেষণে কখন মধ্যবর্তী অবস্থান নিতে পারবেন না। হয় আপনি এপক্ষে না হয় বিপক্ষে। মধ্যবর্তী কোন অবস্থান থাকতে পারেনা। মধ্যবর্তী পথ বলতে বোঝাতে চেয়েছি নিরপেক্ষ অবস্থান, সুযোগ সন্ধানী না।
এখন অনেকেরই প্রশ্ন হতে পারে, নিরপেক্ষতা বলতে কোন কথা নেই, “একমাত্র পাগল এবং শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়।” আচ্ছা, পাগল এবং শিশু বাদ দিলাম। যাদের মস্তিষ্ক সুস্থ এবং স্বাভাবিক তাদের কথাই হিসেবে নিয়ে বলি। যদিও আমাদের মস্তিষ্ক কতটুকু সুস্থ তা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।
০ এবং ১, দশমিকের অঙ্কে এর মধ্যে .০১ থেকে .৯৯ পর্যন্ত সংখ্যা রয়েছে, যদিও তা ভগ্নাংশ। আমি যদি পরিসংখ্যানের পরিভাষায় যাই, তাহলে .৫০ অতিক্রম করলে পরবর্তী সংখ্যা ধরা যায়। এর আগে এবং পরে শূণ্য এবং এক এর পক্ষ বিপক্ষ ধরা যায়।
এখন আসি প্রচলিত জীবনের যে কোন ইস্যুতে মানুষের মতামত প্রসঙ্গে। সেদিন আমার এক প্রাক্তন স্টুডেন্ট সমকালীন ইস্যুতে আমার মতামত জানার জন্য ফেসবুক ইনবক্সে প্রশ্ন করে বসল। “স্যার, এই ব্যাপারটাতে আপনার মতামত কি?” আমি আমার মত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কিছুটা তার মতের বিপক্ষে (পুরোপুরি নয়) গেলে সে ভাবল আমি মনে হয় তার বিপক্ষে কথা বলছি। “আচ্ছা, বুঝতে পারছি, আপনি আমাকে সাপোর্ট করছেন না, আপনি ওদের হয়ে সাপোর্ট করছেন।” আমি চুপ করে রইলাম।
এর মানে কী দাঁড়ায়? এর মানে দাঁড়ায় সে তার নিজস্ব ব্যক্তিসত্ত্বার প্রতি এতটাই মনযোগী এবং নিজেকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যে তার বিপক্ষে সামান্যতম বিরুদ্ধাচারণও সহ্য হয়না। আসলে একটা সময় এ ধরণের আচরণ শুধু সমাজের উচুস্তরের ক্ষমতাসীনদের মধ্যেই দেখা যেত কিন্তু ডেমোক্রেসির এই যুগে যেহেতু সবাই সমান তাই কেউ কারো থেকে কম না।
এখন কথা হচ্ছে ০ এবং ১ এর মধ্যবর্তী অবস্থান কারী মানুষগুলো কেমন? ভাল নাকি খারাপ? যে কোন আদর্শ, নীতি কিংবা ঘটনার বর্ণনায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত থাকে। সে অনুযায়ী তার কাছে যুক্তিও থাকে। একটা এক্সিডেন্টের বর্ণনা আপনি যাত্রী, পথচারী ও চালক-হেল্পারের কাছ থেকে একরকম পাবেন না। ভিন্ন ভিন্ন হবে, কেননা তাদের পয়েন্ট অফ ভিউ আলাদা আলাদা। একই ঘটনা একই সময়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে সবাই দেখলেও বর্ণনার সময়ে তাদের নিজ নিজ মতানুযায়ী ব্যাখ্যা করছে।
মানুষ যে নিজের মতামতের পক্ষে যুক্তি দাড় করায় তার পেছনে কিন্তু একাধিক ফ্যাক্টর বা অনুঘটক কাজ করে থাকে। যে ব্যক্তি খোলা মাঠে চাষাবাদ করে আর যে ব্যক্তি জানালার ধারে বসে কবিতার ছন্দ আওড়ায় তাদের দুজনের কাছে বৃষ্টির বর্ণনা যে একরকম হবেনা তা বলাই বাহুল্য।
আমার আদর্শ, আমার নীতি, আমার দ্বারা বর্ণিত ঘটনা বিশ্লেষণই সঠিক। আমার মতামতের অবস্থান হচ্ছে ১ (এক) মানে সর্বোচ্চ হ্যাসূচক আর ভিন্নমতের হচ্ছে ০ (শূণ্য) মানে নেতিবাচক, এর থেকে দশমিক একও যদি কম কেউ সমর্থন করে তাহলেই সে আমার বিপক্ষে। আমাকে পছন্দ করলে, সমর্থন করলে তাকে অবশ্যই আমার একুরেট বা নির্দিষ্ট পয়েন্টে আসতে হবে। তা না হলে সে আমার বিপক্ষ মতের বলেই বিবেচিত হবে। উল্টো দিক বা মতাদর্শের থেকেও একই ধরণের চিন্তা করা হয়। ঠিক যেন বাইনারি হিসেব।
আদতে ব্যবহারিক জীবন, সমাজ জীবন বাইনারি হিসেব কষে চলেনা, চালানো সম্ভবও না। সমাজতাত্বিক বিশ্লেষণে এটা অন্তত স্পষ্ট যে, সমাজে বসবাসকারী সকলের চিন্তাধারা একরকম না, মতের ভিন্নতা থাকবেই। আর মতের ভিন্নতাই মতবিরোধের কারণ। পৃথিবীর যত বড় বড় সংঘর্ষ হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, প্রাণহানী ঘটেছে, ঘটছে তার মূলে রয়েছে মতবিরোধ। প্রাচীন কালে, রাজতন্ত্রের সময়ে মতবিরোধের জের ধরে জাতি-গোষ্ঠিসমূহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত। কথায় কথায় যুদ্ধ-বিগ্রহ কার ভাল লাগে!
গণতন্ত্র এসে মতবিরোধের জের ধরে হানাহানি বন্ধ করতে চাইল। পরমতসহিষ্ণুতা নামের এক দাওয়ার ব্যবস্থা করল। এ দাওয়া গ্রহণ করলে নাকি একের মত অন্যে মেনে নেবে, তার পরেও যদি মতবিরোধ হয়, তবে আশেপাশের মানুষের মতামত/ভোট নেয়া হবে, যার দিকে সমর্থন বেশি থাকবে তার মতই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। এভাবেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হল।
ফ্যাশন জগতে একটা প্রচলিত কথা আছে, পুরনো ফ্যাশন নাকি ঘুরেফিরে আবার আসে। আর মানবজাতি তো তার শেকড়ের দিকেই ধাবমান। তাহলে এখনকার সমাজের মানুষগুলো যে অসহিষ্ণু আচরন করছে, এটা কি পেছনে ফিরে যাবার ইঙ্গিত? তাহলে কি আবার সব ভেঙ্গেচুরে নতুন করে সাজবে? উত্তর যাই হোক, ইতিবাচক ফলাফল কামনা করা ছাড়া প্রকৃতির কাছে আর কীই বা চাইতে পারি।
নাজমুল হাসান মেহেদি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন